"ডাহুক পাখি: গ্রামবাংলার করুণ সুরের চিরবিরহী"

Comments · 73 Views

ডাহুক পাখি গ্রামবাংলার জলাভূমি ও ঝোপঝাড়ের এক আকর্ষণীয় বাসিন্দা। বর্ষাকালে এদের ‘কোয়াক কোয়াক’ ডাক শোনা যায়, য

গ্রামবাংলার রাতের নীরবতা ভেঙে যখন ঝোপের ভেতর থেকে ভেসে আসে ‘কোয়াক কোয়াক’ ডাক, তখন সহজেই বোঝা যায় যে এটি ডাহুক পাখির ডাক। এই পাখি সাধারণত জলাভূমির আশেপাশের ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকে। ডাহুককে এক ধরনের চিরবিরহী পাখি বলা হয়।

 

গ্রামবাংলায় ডাহুক এবং তার সঙ্গী ডাহুকি নিয়ে অনেক ভালোবাসার গল্প প্রচলিত আছে। কথিত আছে, ডাহুক তার সঙ্গীকে হারালে দিনরাত ডাকতে থাকে। এভাবে ডাকতে ডাকতে তার গলা থেকে রক্ত বের হয় এবং শেষে সে মারা যায়। অন্যদিকে, ডাহুকি তার সঙ্গী হারালে পাগলের মতো ডাকতে থাকে, বিশেষ করে বর্ষাকালে। কেউ কেউ বলে, ডাকাডাকির সময় ওদের গলা থেকে রক্ত পড়ে ডিমের ওপর, আর তাতেই ডিম ফোটে। আবার কেউ বলে, এরা মানুষের জন্য বিপদের সংকেত জানায়। তবে এসব কল্পকথার কোনো ভিত্তি নেই। আসলে, প্রজনন মৌসুমে সঙ্গী আকর্ষণের জন্য ডাহুক এমন করুণ সুরে ডাকতে থাকে। ডাহুককে ‘ডাইক’, ‘পান পায়রা’, ‘ধলাবুক ডাহুক’ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এ পাখি সহজেই পোষ মানে, আর শিকারিরা পোষা ডাহুক ব্যবহার করে বুনো ডাহুক শিকার করে।

 

মাঝারি আকারের এই পাখি দেখতে খুবই সুন্দর। ডাহুকের গড় দৈর্ঘ্য ৩২-৩৩ সেন্টিমিটার। স্ত্রী এবং পুরুষ পাখির চেহারায় তেমন পার্থক্য নেই। এদের লেজ ছোট এবং লালচে আভা সমৃদ্ধ, যা হাঁটার সময় নাচিয়ে রাখে। ডাহুকের পা লম্বা, আর পায়ের নখগুলো এমনভাবে তৈরি যে এটি পদ্ম বা শাপলা পাতার ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে এবং কচুরিপানার ওপর অনায়াসে ছোটাছুটি করতে পারে। পিঠের রং ধূসর থেকে খয়েরি-কালো, আর মাথা, গলা, বুক ও পেট পুরোপুরি সাদা। হলুদ ঠোঁটের ওপরে একটি লাল দাগ দেখা যায়। তবে ডাহুকের বাচ্চারা সবসময় কালো রঙের হয়।

 

ডাহুকের প্রধান খাবার জলজ পোকামাকড়, ছোট মাছ, জলজ উদ্ভিদের কচি অংশ, শ্যাওলা এবং ধান। পোষা ডাহুক চাল বা ভাত খায়। খাবারের খোঁজে এরা কখনও মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। বাসা বাঁধে জলাভূমির ধারে ঝোপঝাড় বা বাঁশঝাড়ে, তবে পানি এদের প্রধান আশ্রয়স্থল। এরা অত্যন্ত সতর্ক এবং আত্মগোপনে পারদর্শী। পুকুর, খাল, জলাভূমি, বিল এবং নদীর গোপন স্থান এদের প্রিয় আশ্রয়।

 

ডাহুকের প্রজননকাল জুন থেকে সেপ্টেম্বর। এ সময় ডাহুক ৬-৭টি ডিম পাড়ে, যার রং ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ডিমে তা দেয় উভয় পাখি, আর ডিম ফুটতে ১৮-২০ দিন সময় লাগে।

 

বাংলাদেশ, ভারতসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ডাহুক পাখি পাওয়া যায়। তবে শিকার ও বাসস্থানের অভাবে এ পাখি এখন প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে বসেছে। আইইউসিএন ডাহুককে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী আইনে এই পাখি সংরক্ষিত।

 

Comments